বর্ষার সজল বারিধারা, বসন্তের মাধুরী এমনকি গ্রীষ্মের আগ্রাসী প্রখরতা নিয়ে বাংলা কবিতা-গানের ভুবন যতটা আলোকিত ও মুখর, তার এক-দশমাংশও নয় হেমন্ত কাল নিয়ে। তারপরও শিল্প-সাহিত্যে-চিত্রকলায় নানা রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে হেমন্ত কাল। পাশ্চাত্যেও শিল্পীরা দু হাত উজাড় করে এঁকেছেন হেমন্তের অপরূপরূপ ময়তা, তবে কারো কারো ছবিতে পড়েছে বিষন্নতার ছোপ ও ছায়া। ভ্যানগঘের ছবি থেকে বিচ্ছুরিত হয়েছে সর্বকালীন বিষাদেও অপার্থিব সুর।
বাঙালি কবিরা অধিকাংশই হেমন্তকে দেখেছেন ধান কাটার রোঞ্চকর দিন হিসেবে, অবশ্য কারো কারো কবিতায় হেমন্ত কাল মানে জরা-মৃত্যুর গন্ধ ছড়ানো বিষন্ন দিন রাত্রি। তবে হেমন্তে ফসলের প্রাচুর্য ও পাকা ধানের গুচ্ছের উজ্জ্বল সোনালি বিভা আমাদের মন ভরিয়ে দেয়। অথচ রবীন্দ্রনাথের গানে-কবিতায় হেমন্ত কাল সেই ভাবে ঠাঁই পায়নি। কেতকী কুশারী ডাইসনের ‘রবীন্দ্রনাথের বর্ণ ভাবনা’ থেকে জানাযায়, তিনি নাকি হেমন্তের লাল-গেরুয়ারঙটি দেখতে পেতেন না। এ কারণে তাঁর সৃজন বিশ্বে বর্ষা, বসন্ত, শরৎ এমনকি গ্রীষ্ম ঘুরে ফিরে এলেও হেমন্তের প্রতি উপেক্ষা দেখিয়েছেন নিদারুণ ভাবে। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত বারবার ফিরে এসেছে বিচিত্র রূপে বিচিত্র বর্ণে। বাংলার গাছপালা, লতাগুল্ম , মেঠো চাঁদ, নদী-নিসর্গের অপরূপে মুগ্ধ কবির কাছে হেমন্ত মানে অঘ্রাণ- তাঁর কাছে কার্তিকের চেয়ে অগ্রহায়ণ ঢের বেশি উজ্জ্বলতর। তিনি লিখেছেন : ‘অশ্বত্থ পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে/ শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া,-অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু;’ ( অঘ্রান প্রান্তর, বনলতা সেন) অগ্রহায়ণ মানেই‘আমন’ধান কাটার মাস। ‘ বাংলার শস্য হীন প্রান্তরে ’যখন‘গভীর অঘ্রান’এসে দাঁড়ায়, তখন উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশ-অন্তরীক্ষে। অগ্রহায়ণ বয়ে আনে ধান কাটার রোমাঞ্চকর দিন, বয়ে আনে সমৃদ্ধি। ফসলের সম্ভার কিষাণ-কিষাণীর প্রাণ মন ভরিয়ে দেয় অলৌকিক আনন্দে। বর্ষায় রোয়া ‘আমন’ ধান অগ্রহায়ণ মাসে কাটা হয়। ধান কাটার পরপরই গ্রামের ঘরে ঘরে আয়োজন করা ‘নবান্নউৎসব’। আমাদের দেশে হেমন্ত কাল নবান্নের কাল হিসেবে বিবেচিত হয়।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত রমেশচন্দ্র দত্তের ‘বাংলার কৃষক’ (১৮৭৪) গ্রন্থে বলা হয়েছে, আমন ধান ভরা বর্ষায় রোপণ করা হয় নিচু জমিতে। ধান কাটা হয় বাংলা সনের অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে। অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবকে ‘আমন পার্বণ’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমন কাটা শেষে আনন্দ-উল্লাসের সাথে বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান হলো ডিসেম্বরের শীতের মতো উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ ভোজন এবং বিভিন্ন উপায়ে তৈরি উষ্ণ ও সুস্বাদু পিঠা বিতরণ।